earthquakeইন্ডিয়ান প্লেটের ওপর মূলত আমাদের বাংলাদেশ অবস্থিত। আর এ প্লেট ক্রমাগতভাবে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যার পরিমাণ প্রতিবছরে ৪ দশমিক ৬ থেকে ৪ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার। এর ফলে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া গত ৫৫ মিলিয়ন বছর ধরে চলছে। যার পরিণতিতে হিমালয় পর্বত ও ইন্দো বার্মা রেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

৪ জানুয়ারি সারা দেশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পর এর পূর্বাপর নিয়ে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন। পাঠকদের জন্য তার বক্তব্যের চৌম্বকাংশ তুলে ধরা হলো।

৪ জানুয়ারি যে ভূমিকম্পটা হয়ে গেল, তার উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে, যা ঢাকা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। রিখটার স্কেল অনুযায়ী এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭ থেকে ৬ দশমিক ৮। এটি ভূমির ৫৫ কিলোমিটার গভীরে হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ঠিক কত মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকা শহরের জন্য বিপজ্জনক? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, এটি নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর।

এক. ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরুত্ব; দুই. কম্পনের তীব্রতা এবং তিন. ভূমিকম্পের পর উৎপত্তিস্থলের গভীরতা।

এ ক্ষেত্রে যদি ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ১৫০ বা তার কাছাকাছি দূরত্বে হয়ে থাকে আর কম্পনের মাত্রা ৭ বা তার কাছাকাছি হয়, তাহলে এটা হবে বেশ বিপজ্জনক। পুরাতন ও বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত ভবনগুলো ধসে যেতে পারে। তবে এ পর্যন্ত এত কম দূরত্বে এত অধিক তীব্রতার কোনো ভূমিকম্পের কথা জানা যায়নি।

অন্যদিকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ঢাকা শহর থেকে ২০০ বা ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে আর কম্পনের মাত্রা ৮ বা তার কাছাকাছি হলে খুব সম্ভবত ৫০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে ঢাকা শহরের মাটির ভালো-মন্দ দুটো দিক রয়েছে। আমরা জানি, ঢাকা শহর নরম মাটির ওপর অবস্থিত। ফলে এ মাটি সহজে ভূকম্পন শোষণ করতে পারে। আবার অন্যদিকে মাটি নরম হওয়ার কারণে, বিশেষ করে বহুতল ভবনগুলোর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি। তবে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব। এসব এলাকায় বিগত সময়ে কত কত মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, তা মাটি পরীক্ষাসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আঁচ করা সম্ভব।

অনেকে বলে থাকেন, ভূমিকম্পের বিষয়টি পশুপাখি বুঝতে পারে। তবে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যতটুকু ধারণা করা হচ্ছে তা হলো, যেসব প্রাণী মাটির স্বল্প গভীরে বসবাস করে, এরা ভূমিকম্পের প্রাক্কালে অস্বাভাবিক আচরণ করে। যেমন : ইঁদুর, পিঁপড়া, ব্যাঙ ইত্যাদি।

ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময় পরপর ভূমিকম্প হতে পারে। একে ভূকম্পন চক্র বলা যেতে পারে। যেমন : ১৮৯৭ সালে ৮ মাত্রায় শিলংয়ে ভূমিকম্প হয়েছে। আসামে হয়েছে ১৯৫০ সালে ৮ দশমিক ৬ মাত্রায়। বার্মার সায়গংয়ে ১৯৪৬ সালে হয়েছে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প।

আমরা জানি, শিলং ভূমিকম্পের প্রভাবে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে গেছে।

সামগ্রিকভাবে এই তিনটি অঞ্চলের ভূকম্পনের ইতিহাস বলে, এসব অঞ্চলে সাধারণত ৫০ বছর পরপর বড় ধরনের কম্পন ঘটে থাকে। যেহেতু ১৯৫০-এর পর এ অঞ্চলে বড় ধরনের কোনো কম্পনের ঘটনা ঘটেনি। তাই আমরা একটা বিষয় ধারণ করতে পারি যে, অচিরেই এসব অঞ্চলে বড় ধরনের কম্পন হতে পারে।

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলো হলো উত্তরে সিলেটের ডাউকি ফল্ট (ঢাকা শহর থেকে দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার), উত্তর-পূর্বে কাবাউ ফল্ট (ঢাকা শহর থেকে দূরত্ব ৩৫০-৪০০ কিলোমিটার) ও পূর্বে রয়েছে মিয়ানমারের (বার্মা) সায়গং ফল্ট (ঢাকা শহর থেকে দূরত্ব ৬০০ কিলোমিটার)।

সিলেটের ডাউকি ফল্টের ঐতিহাসিক ডাটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ অঞ্চলে একটি ভূকম্পন চক্র রয়েছে, যা ৫০০ বা ১০০০ বছর পর পর ঘটে থাকে। এ জন্য বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ এটি ১৫০ কিলোমিটারের মতো স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত।

আর সায়গং ফল্টে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকবে চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো।